অ্যাডভোকেট আইন ব্যবসায়ী। একজন অ্যাডভোকেট যুগপৎ তার মক্কেলের প্রতিনিধি এবং আদালতের একজন কর্মকর্তা। মক্কেলের প্রতি একজন অ্যাডভোকেটের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে আদালতের প্রতিও। ঔপনিবেশিক শাসনামলে পদটির উদ্ভব হয়। প্রাক-ব্রিটিশ যুগে অ্যাডভোকেটের অনুরূপ পেশার লোক ছিলেন ‘ওয়াকিল’। এ ওয়াকিল মুগল দরবারে তার মক্কেলের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতেন। কিন্তু তিনি দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় কোনো সংগঠিত পেশার সদস্য ছিলেন না।
১৭৭৪ সালে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাডভোকেট ব্যবস্থা চালু হয়। ১৭৯৩ সালে এ ব্যবস্থা কর্নওয়ালিস কোড-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৯৩ সালের প্রবিধান ৭-এর আওতায় সদর দীউয়ানি আদালতকে ওই আদালত অথবা তার অধীনস্থ আদালতে আইন ব্যবসায়ের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উকিল হিসেবে সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৮১৪ সালের প্রবিধান ২৭-এর মাধ্যমে জেলা আদালতগুলিকে ঐসব আদালতে আইন ব্যবসায়ের জন্য উকিলদের সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৮৩৩ সালের প্রবিধান ১২-এর আওতায় সদর দীউয়ানি ও নিজামত আদালতে আইন ব্যবসার জন্য উকিলদের সনদপত্র প্রদানের বিধান রাখা হয়। ১৮৪৬ সালের লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যাক্টে অ্যাডভোকেটদের যোগ্যতা ও কার্যাবলি নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয়।
ওকালতির জন্য তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় যোগ্যতা অর্জনকারী ব্যক্তিদের সনদপত্র প্রদানের ব্যবস্থা ১৮৫০ সালে প্রবর্তন করা হয়। এক্ষেত্রে আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের উকিল হিসেবে নিয়োগের জন্য এ ধরনের তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো না। ১৮৬৫ সালের লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যাক্টের বিধানমতে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উকিল, মোক্তার বা রাজস্ব এজেন্ট হিসেবে আইন ব্যবসায়ের জন্য সনদপত্র প্রদান করা হতো। ১৮৭৬ সালের লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যাক্টের আওতায় হাইকোর্টকে উকিল, মোক্তার ও রাজস্ব এজেন্টদের সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। উকিলরা সকল অধীনস্থ দীউয়ানি ও ফৌজদারি আদালত এবং রাজস্ব দপ্তরগুলিতে আইন ব্যবসা করতে পারতেন; আর মোক্তাররা শুধু ফৌজদারি আদালতে এবং রাজস্ব এজেন্টরা কেবল রাজস্ব দপ্তরে আইন ব্যবসার যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন।
প্রথম অবস্থায় অ্যাডভোকেটরা মূল ও আপিল উভয় ক্ষেত্রেই হাইকোর্টে প্রাকটিস করতে পারতেন এবং উকিলরা কেবল আপিল বিষয়ে প্রাকটিস করতেন। ১৯২৬ সালের কাউন্সিল অ্যাক্টের মাধ্যমে অ্যাডভোকেট এবং উকিলদের মধ্যকার এ পার্থক্যের অবসান ঘটে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সালের লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্টের মাধ্যমে অ্যাডভোকেট ও অন্যান্য আইন ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরাজমান পার্থক্যের নিরসন করে দু শ্রেণির অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তির বিধান করা হয়। এর একটি শ্রেণি হাইকোর্ট এবং অন্যরা অধীনস্থ আদালতগুলিতে আইন ব্যবসার অধিকার লাভ করেন। এ আইনে উকিল, মোক্তার ও রাজস্ব এজেন্ট অভিধা বিলোপ করে এদের নিম্ন আদালতের অ্যাডভোকেট পদবি প্রদান করা হয়। নিম্ন আদালতের একজন অ্যাডভোকেট কয়েক বছর আইন ব্যবসার পর হাইকোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারতেন।
১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২-এর বিধান অনুসারে অ্যাডভোকেটগণ তালিকাভুক্ত হয়ে আসছেন এবং উক্ত বিধান দ্বারা তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ আদেশের অধীনে অ্যাডভোকেটদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বার কাউন্সিল গঠিত হয়। বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল পদাধিকার বলে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান থাকেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অথবা অধীনস্থ আদালতগুলিতে আইন ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিল যোগ্য ব্যক্তিদের সনদ প্রদান করে থাকে। নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ অথবা ব্যারিস্টার হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি একজন অ্যাডভোকেটের দপ্তরে ছয় মাস শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করে বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন। যে অ্যাডভোকেটের অধীনে তিনি শিক্ষানবিশ থাকবেন তাকে কমপক্ষে সাত বছর আইন ব্যবসার অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। লিখিত পরীক্ষায় পাসের পর প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের নিম্ন আদালতগুলিতে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত লিগ্যাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনিস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত বার ভকেশনাল কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। যেকোনো নিম্ন আদালতে অ্যাডভোকেট হিসেবে দু বছর আইন ব্যবসার পর কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন, যদি অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক ওই ধরনের আইন ব্যবসার শর্ত তার ক্ষেত্রে শিথিল করা না হয়ে থাকে। তালিকাভুক্তির জন্য এ ধরনের একজন প্রার্থীকে বার কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে পাঁচ বছর আইন ব্যবসার পর কোনো ব্যক্তি আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নিকট আবেদন করতে পারেন। আপিল বিভাগে কয়েক বছর আইন ব্যবসায়ে অভিজ্ঞ একজন অ্যাডভোকেট আপিল বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারেন।
লেখক: কাজী এবাদুল হক
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি।
No comments:
Post a Comment